কোন পথে ইমরানের ভাগ্য?

সামরিক গোষ্ঠীকে খেপিয়ে হয়রানির শিকার পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই প্রধান ইমরান খান এখন অনেকটাই কোণঠাসা। অবশ্য তার অগুনিত কর্মী সমর্থক আর বিচার বিভাগ এখনও তাকে ছেড়ে যায়নি। কিন্তু তার চলমান যে বেগতিক অবস্থা, সেটি তাকে কোথায় নিয়ে চলেছে তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। 

সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আলোচনার জন্য পাকিস্তান সরকারের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন ইমরান খান। তবে সেই আলোচনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টুইট করে জানিয়েও দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দল পিএমএলের প্রধান ও সরকার প্রধান শেহবাজ শরিফের ভাই নওয়াজ শরিফ। টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদের মধ্যে আলোচনা হয়। কিন্তু যারা জঙ্গি ও দাঙ্গাবাজ, যারা সরকারি ভবনে আগুন দেয়, শহিদের মূর্তি ভেঙে ফেলে তাদের সঙ্গে কোন কথা হবে না।’ 

সেনাবাহিনী তো আছেই, পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল পিএমএল যেভাবে ইমরান খানের পেছনে লেগেছে তাতে একেবারেই স্বস্তিতে নেই ইমরান খান। সম্প্রতি লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাও দিয়েছেন, ‘যদি তাকে অযোগ্য ঘোষণাই করা হয় তবে দলের নেতৃত্ব দেবেন পিটিআই ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মেহমুদ কুরেশি।’ নিজেকে নিয়ে যখন ইমরান খান নানা শঙ্কার মধ্যে, তখন তার দলের পরিস্থিতিও ভালো বলা যাবে না। তার নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের অনেক সিনিয়র নেতা জেলে যাওয়ার ভয়ে একে একে পদত্যাগ করেছেন। তবে তারপরও তিনি ক্ষমতায় ফেরার লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলেই জানিয়েছেন। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেছেন, ‘যারা দল ছেড়েছে তাদের জায়গায় তরুণ রাজনীতিবিদদের বসানো হবে।’ অবশ্য তাদেরও যে জেলে পাঠানো হবে না, সে নিশ্চয়তা খোদ ইমরান খানও দিতে পারেননি। 

এর আগে চলতি বছরের ৯ মে মামলার হাজিরা দিতে যাওয়ার সময় ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বায়োমেট্রিক দপ্তর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেনাবাহিনী ও সরকারের যৌথ অভিযান স্পষ্টতই বেআইনি ছিল বলে দেশটির কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। বলা হয়, আদালত থেকে এভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না। তবে যে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহল নিন্দা জানায় তা হলো, দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানকে এভাবে অপমানজনক ভাবে শারীরিক আঘাত করে ও টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলা উচিৎ হয়নি। 

এদিকে, ইমরান খানকে গ্রেফতারের পর টানা চারদিন অঘোষিতভাবে সেনা হেফাজতে রাখার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তার সুস্থতা ও বেঁচে থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সমালোচকেরা প্রশ্ন তোলেন, ইসলামাবাদ হাইকোর্ট কিভাবে তার গ্রেপ্তারকে বৈধতাও দেয়? আবার তার রিমান্ডও মঞ্জুর করে? সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি যদি তার বলিষ্ঠ হস্তক্ষেপ না করতেন তাহলে ইমরান খানের প্রাণের আশঙ্কার যথেষ্ট কারণও ছিল। ইমরান খানের গ্রেফতার এবং পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ইতিবাচক খবর এই যে, মঙ্গলবার (৩০ মে) সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে হওয়া এক মামলায় জামিন পেয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য তার এই জামিনের মেয়াদ আগামী ২ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে। দেশটির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অন্তত এব্যাপারে নিশ্চিত যে, এ সময়ে তাকে এই মামলায় আটক করা যাবে না।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারে জাতীয় দলে নেতৃত্ব দেয়া ইমরান খান পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দিয়েছিলেন। এটা অবশ্যই ছিল তার সফলতা। ক্যারিশমেটিক মানুষটি প্লেবয় হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তবে হঠাৎ তার রাজনীতিতে আসা সেসময় অনেককেই অবাক করেছিল। তার চেয়ে বেশি হতবাক করেছিল, অল্প ক'দিনের মধ্যেই বিপুল সমর্থন নিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদ জিতে নেয়া। অবশ্য সেই বিস্ময় কাটতে বেশি সময় লাগেনি যখন পরিষ্কার হয়ে যায় যে এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাবাহিনীর সমর্থন। দেশটির সংবাদমাধ্যমের কারণে সবার জানা হয়ে যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সংকটকালে একজন ত্রাতা খুঁজছিলো। সেই ত্রাতা হিসেবে ইমরান খানকেই তাদের মনে ধরে। অবশ্য সেনাবাহিনীর দৃষ্টিতে মনোনীত মানুষটি মাত্র একবছরের মাথায় 'চিরশক্র'তে পরিণত হন। ইমরান খানের আক্রোশ থেকে বাঁচতে সেনাবাহিনীও তাই সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। যা এখনো চলমান। 

পাকিস্তানে সেনাবাহিনী যে কতোটা প্রভাবশালী তা অতীত ইতিহাস ঘাঁটলেই প্রমাণ মেলে। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা এতোটাই যে তাদের বিরুদ্ধে গেলে পরিণতি ভয়াবহও হতে পারে। দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নজির যেমন আছে তেমনি তার মেয়ে বেনজির ভুট্টোর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে দুবার অপসারণ এমনকি পরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহতের রহস্যময় ঘটনাও আছে। যে ঘটনার পূর্ণ তদন্ত কখনো হয়নি। আবার আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকেও অপসারিত হওয়ার স্বাদ নিতে হয়েছে। যেতে হয়েছে কারাগারে, হয়েছেন নির্বাসিত। নওয়াজের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনো বিদেশেই আছেন। প্রশ্ন আছে শাহবাজের মাধ্যমে নওয়াজই কার্যত দেশ চালান, কিন্তু তিনি পাকিস্তানে ফিরছেন না কেন? কারও কারও মতে, অতীত ইতিহাস থেকে নওয়াজ এতটাই শিক্ষা পেয়েছেন যে, ভাই প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকলেও দেশে ফেরার ভরসা এখনো তিনি করে উঠতে পারেননি। যদি দেশেও ফেরেন, পাকিস্তানের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট তাকে স্বস্তি দেবে না। 

যাইহোক, ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং ২০২২ সালে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে ইমরানের বিদায় দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর পর থেকে নির্বাচনের দাবিতে ইমরান খান ও তার দল আন্দোলন করে চলেছেন। এখন নানা নাটকীয়তায় ঘেরা তারকা এই ক্রিকেটারের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা দেখতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা তো করতেই হবে!


মন্তব্যসমূহ