এ জগৎ তোমার নয়! পর্ব- ৬
৪.
ডার্ক ওয়েবে লোকটির সঙ্গে চ্যাটিং করার এক পর্যায়ে হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেল অপর প্রান্ত। এরপর আরও দুটি প্রশ্ন করেও যখন জবাব মিললো না তখন বুঝলো, ওপ্রান্তের লোকটি কোনো কারণে আর কথা বলবে না। আবার সংযোগ বিচ্ছিন্নও হতে পারে। রহস্যময় অজানা প্রজেক্টটা নিয়ে দিপা এতটাই কৌতূহলী হয়ে উঠেছে যে, সময় কিভাবে পেরিয়ে যাচ্ছে- টেরও পায়নি।
এখানে আর সময় নষ্ট না করে অন্য কারও কাছে খোঁজ নেবে বলে ঠিক করলো ও। কিন্তু অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড প্রসঙ্গে খোঁজ শুরু করতেই ওর কম্পিউটারের মনিটর হঠাৎ কালো হয়ে গেল। এরপরই ওর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা অনুভূতি জাগিয়ে মনিটরে ফুটে উঠলো একটি লেখা। ‘We are watching you.’
ঝট করে সোজা হয়ে বসলো দিপা। ডার্ক ওয়েব থেকে গতানুগতিকভাবে বের না হয়ে দ্রুত কম্পিউটারের পাওয়ার অফ করে দিলো সে। আতংকিত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতেই দেখতে পেল, পুরো ল্যাবে কোনো মানুষ নেই। তবে এক ব্যক্তি খুব মন দিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। লোকটিকে সে চেনে না। কাকে খুঁজছে তাও জানে না। তবে তার অবচেতন মন বললো, লোকটি তাকে দেখার আগেই ল্যাব থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। যদিও ও জানে লোকটির চোখ ফাঁকি দিলেও সিসি ক্যামেরার নাগাল এড়ানো যাবে না। তাও যথাসম্ভব নিজেকে আড়াল করে ল্যাব থেকে বের হয়ে আসলো সে। দিপাকে যে বিষয়টা অবাক করেছে তা হলো, দুপুর গড়িয়ে গেলেও ক্লাস টাইমে ল্যাবে অনেক শিক্ষার্থীর দেখা মেলে। কিন্তু এসময় এমন কি হলো যে সেখানে কেউ নেই? শুধু তাই নয়, করিডোরে এসেও কারও দেখা সে পেল না। ওর মন বলছিল, ক্যাম্পাসে কিছু একটা হয়েছে। ল্যাবে চাটিং-এ ব্যস্ত থাকায় সে কিছুই জানতে পারেনি।
দিপা দ্রুত পায়ে হেঁটে ওর লকারের কাছে আসলো। মোবাইল ফোনসহ ওর ব্যাগটা নিয়ে গেটের কাছে যেতেই ক্লাসের এক মেয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। এখনও ক্লাসের সবার সঙ্গে ওর পরিচয় হয়ে ওঠেনি। তবে যে কয়জনের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়ে তার মধ্যে এই মার্থা মেয়েটা বেশ হাসিখুশি। প্রথম প্রথম ক্লাসে ও চুপচাপই বসে থাকতো। মার্থাই একদিন এগিয়ে এসে তার সঙ্গে পরিচিত হয়। এরপর ক্লাসের ফাঁকে প্রায়ই কথা হয় দুজনের। দেখা হতেই মার্থার কাছে সে জানতে চাইলো,
“কি ব্যাপার, ক্যাম্পাসে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না যে?”
“আর বলো না, ক্লাস তো ঠিকই চলছিলো। হঠাৎ প্রিন্সিপালের কাছ থেকে নির্দেশ আসে, জরুরি কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম আজকের জন্য বন্ধ থাকবে। সবাই যেন দ্রুত ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। হোম অফিসের নাকি নির্দেশ।”
“তাহলে যে অ্যালার্ম পেলাম না?”
“সে ব্যাপারেও নির্দেশে বলা ছিল যে, হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে কোনো ধরনের প্যানিক যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে না ছড়ায় তাই অ্যালার্ম দেয়া যাবে না। ক্লাসে ক্লাসে লোক গিয়ে সবাইকে ধীরেসুস্থে বের করে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে আজ বিশেষ কারণে আর ক্লাস হবে না। সবাই যেন দ্রুত বাড়ি চলে যায়।”
এই বলে মার্থা ডান দিকে তাকালো। এরপর দিপাকে বললো, “ঐ যে মিস্টার ওলিভারকে দেখছো। উনি কলেজের রেজিস্টার। ওনার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক, জিজ্ঞেস করাতে তিনিই সব বললেন।”
ওলিভারকে নিয়ে কথা হচ্ছে বুঝতে পেরেই বোধহয় তিনি এগিয়ে এলেন, “হাই মার্থা, কি ব্যাপার আমাকে নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে নাকি?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দিপার দিকেও তাকালেন তিনি।
“হ্যাল্লো ওলিভার, পরিচয় করিয়ে দেই।” দিপার দিকে ফিরে মার্থা বললো। “ও দিপা, বাংলাদেশ থেকে এসেছে। আমরা একই ক্লাসে পড়ি। আর ওনার কথা তো বলছিলাম, উনি মিস্টার ওলিভার। আমাদের কলেজের রেজিস্টার।”
সম্ভাষণের পর দিপাই কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো, "হোম অফিস থেকে এরকম নির্দেশ কি প্রায়ই আসে?" জবাবে ওলিভার বললেন,
“আর বলো না। নেটওয়ার্কের গণ্ডগোল কিনা বুঝতে পারছি না।হোম অফিস থেকে এরকম নির্দেশ আসেইনি। পিসি চেক করার সময় আমিই প্রথমে মেইলটা দেখতে পাই। কলেজের অফিশিয়াল মেইলে কলেজ বন্ধের এমন নির্দেশ পেয়ে আমি প্রিন্সিপ্যালকে বিষয়টা জানাই। আমরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকলে হোম অফিস থেকে এমন নির্দেশ আসারই কথা না। মাঝে মাঝে ফায়ার ড্রিল হয়, কিন্তু সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের আগেই জানানো হয়। কিন্তু হোম অফিসের এমন চিঠিতে আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, কোনো ধরনের সন্ত্রাসী হামলার তথ্য আছে বলে এমন নির্দেশ এসেছে। কিন্তু কলেজ খালি করে রুমে গিয়ে পিসি অফ করতে গিয়ে দেখি, মেইলটা নেই।”
“মানে?” মার্থা আর দিপা দু’জনের মুখ থেকেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো।
“মানে, মেইলটা যে এসেছিল, তারই কোনো প্রমাণ নেই। ভেবেছিলাম বুঝি ডিলেট হয়ে গেছে। কিন্তু ট্র্যাশেও মেইলটা খুঁজে পেলাম না। ভাগ্যিস, প্রিন্সিপ্যালকে জানানোর জন্য মেইলটা প্রিন্ট দিয়েছিলাম। তা না হলে তো কঠিন শাস্তির মুখে পড়তে হতো আমাকে।” বলতে বলতে কপালের ঘাম মুছলেন ওলিভার।
“হয়তো পিসিতে অন্য কেউ বসেছিল। সেই হয়তো ট্র্যাশ বিন থেকেও ডিলেট করে দিয়েছে।” মার্থা বললো।
“অসম্ভব! কলেজের অফিশিয়াল মেইল একমাত্র আমারই পিসিতে খোলা থাকে এবং সেখানে বসার অনুমতি কারও নেই। প্রয়োজনে আমি সি সি ক্যামেরা চেক করে দেখবো। তবে আমি নিশ্চিত এটা মেইলের কোনো ক্রুটির কারণে হয়েছে। হোম অফিসকেও মেইল করতাম, কিন্তু সেই মেইলটাই তো নেই।” ওলিভারের মুখ দেখেই দিপারা বুঝতে পারছিল, হতবাক ভাবটা এখনো কাটেনি তার। রেজিস্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার দিকে এগুলো দু’জনে। কিছুক্ষণ পরে মার্থার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দিপা বাড়ির পথ ধরলো।
বাসে ওঠার আগে ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করলো দিপা। স্ক্রিনেই ফুটে আছে, ‘Any wrong step will be your last step.’ ম্যাসেজটা দেখে থমকে দাঁড়ালো দিপা। মানে ওরা কি সব জেনে ফেলেছে? দুশ্চিন্তা ক্রমেই আতংকে পরিণত হচ্ছে দিপার। বুঝতে পারছে, গতকাল না বুঝে যে ভুল করেছে তার মাশুল এখন তাকেই গুনতে হবে। কিন্তু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নয়, এই পরিস্থিতি থেকে কিভাবে বের হয়ে আসা যায় সেটা নিয়েই ভাবতে হবে তাকে।
(চলবে…)

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন